সারা রাত আমার হাত বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতেন, ঘুম থেকে চোখ খুলেই দেখতাম মাইয়া (মা) আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চোখ তার চোখে পড়ার সাথে সাথে ভুবন জুড়ানো একটি হাসি দিতেন। তিনি আগে থেকেই রাতে তেমন ঘুমাতেন না, জেগে জেগে নামাজ পড়তেন, যিকির করতেন। ব্রেন স্ট্রোক করার পর মাইয়ার শরীরের বাম পাশ অবশ হয়ে যায়, তখন থেকে সবসময় শুয়েই থাকতেন, তাই রাতে আর তার ঘুম আসত না। অসুস্থ ছিলেন, তবু ছিলেন… বিছানার যে জায়গাটাই আমার মা থাকতেন, আজ একবছর পরও তাকালে মনে হয় তিনি ওখানেই আছেন। ভাবতাম মাকে ছাড়া কিভাবে থাকব, এরপরও সময় চলে যাচ্ছে…
আমার মা গত বছর এই দিনেও আমার কাছে ছিলেন, আমাদের পাশে ছিলেন, আজ নেই… জীবনের প্রয়োজনে কিছু সময় ছাড়া ছোটবেলার মতো মায়ের কাছাকাছি আর থাকার সৌভাগ্য হয়নি। যখন তাকে আবার কাছে পেয়েছিলাম, সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম, দূর্ভাগ্য যে তিনি তখন তেমন কিছুই বুঝতেন না। যখন সুস্থ ছিলেন তখন অনেক কাছে রাখতে চেয়েছি, গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আসতে চায়নি। যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন আর মানা করতে পারেননি।
আমার মা গ্রামের সাধারণ একজন নারী হয়েও অসাধারণ ছিলেন – কোনদিন আরম্ভর, অহংকার করতে দেখিনি, কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ করতে দেখিনি। কখনো গহনা পরতে বা শখ করতে দেখিনি, বলতেন মরার পর গহনা সাপ হয়ে পেচিঁয়ে ধরবে, আরম্ভর-অহংকার আল্লাহর অপছন্দ। মৃত্যুর পর তার জীবনের হিসাব কতটা স্বচ্ছ রাখা যায়, আমার মা সেভাবেই দিন-যাপন করতেন, কর্ম করতেন। লিখতে পড়তে জানতেন না, কিন্তু জ্ঞানের প্রতি, সত্য-সুন্দর কিছু জানার প্রতি কখনো আগ্রহের কমতি ছিল না।
আমাদের পিঠা-পিঠি আট ভাইবোনকে মানুষ করছেন, কোনদিন একটু বিরক্ত-রাগ পর্যন্ত করেননি, সারাদিন বিশাল একটি সংসারের কাজ করার পরও কোনদিন নামাজ-রোজা বাদ দিতে দেখিনি। এমনকি শীতের কনকনে ঠান্ডায়ও কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ বাদ দিতে দেখিনি। নিজের সাধ্যের মধ্যে এবং সাধ্যের বাইরে দান-খয়রাত করতেন, কখনো কাউকে ফিরিয়ে দিতে দেখিনি, কম হলেও দিতেন, সে আত্মীয়, অনাত্মীয়, আর দরিদ্রই হোক না কেন। সারাজীবনের একটু একটু করে কষ্ট জমানো অর্থ দিয়ে তিনি একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমি গর্বিত এমন মায়ের গর্ভে জম্ম নিয়ে। শুধু কষ্ট হয় এটা ভেবে যখন তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম তখন তিনি কিছুই বুঝতেন না, তিনি নিজেই কত কষ্টে ছিলেন – সারা দিন-রাত শুয়ে থাকার কষ্ট, এতে সচেতন মা আমার বলতে গেলে ছিলেন অচেতন।
আমার মা বেচেঁ থাকতে আনেক কষ্ট করেছেন, দোয়া করি আমার মাকে আল্লাহ যেন সবচেয়ে সুন্দর স্থানে, শান্তিতে রাখেন, সবধরনের কষ্ট থেকে অনন্তকাল মুক্ত রাখেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবসময় তটস্থ থাকতেন, আল্লাহ যেন তার বিনিময়ে তার যোগ্য সম্মান দেন।